উপাচার্যের বাসনাবিলাস
![]() |
‘আমাকে যদি বলা হয়, আপনি যুবলীগের দায়িত্ব নিতে পারবেন কি না? তবে আমি সঙ্গে সঙ্গে উপাচার্য বা চাকরি ছেড়ে দেব এবং যুবলীগের দায়িত্ব নেব।’
মীজানুর রহমান, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
খবরটি পড়ে খটকা লাগল। সত্যিই তিনি এ কথা বলেছেন কি না। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেন যুবলীগের সভাপতি হতে চাইবেন! পরে খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম, বৃহস্পতিবার একটি টেলিভিশনের টক শোতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেছেন, ‘আমি উপাচার্য হওয়ার পর আর কোনো (যুবলীগের) মিটিংয়ে যাই না। তবে যদি আমাকে এখনো বলা হয় যুবলীগের দায়িত্ব নিতে হবে, আমি ভাইস চ্যান্সেলরের পদ ছেড়েই দায়িত্ব নেব। ...আমাকে যদি বলা হয়, আপনি যুবলীগের দায়িত্ব নিতে পারবেন কি না? তবে আমি সঙ্গে সঙ্গে উপাচার্য বা চাকরি ছেড়ে দেব এবং যুবলীগের দায়িত্ব নেব।’
মীজানুর রহমান ২০১৩ সালের ২০ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। সাড়ে ছয় বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তাঁর মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো যুবলীগের সভাপতির পদ। অথবা তিনি জেনে গেছেন যে তাঁর উপাচার্য পদটি নড়বড়ে। অথবা যুবলীগই তাঁর প্রাণের সংগঠন। কিন্তু এই প্রাণের সংগঠন কীভাবে ক্যাসিনো সংগঠনে পরিণত হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি। শুধু বলেছেন, ‘সম্প্রতি ক্যাসিনো-কাণ্ডে কোটি কোটি তরুণ বিভ্রান্ত হয়েছেন। এই সংগঠনের জন্য অনেক কষ্ট করেছি। এখন সংগঠনটি একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোটি তরুণকে ফের সঠিক পথে আস্থার মধ্যে ফেরাতে আমাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হলে আমি তা পালন করব।’
মীজানুর রহমান বিপন্ন যুবলীগকে উদ্ধারের বাসনা ব্যক্ত করেছেন, তখন তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে সাড়ে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কী পরিস্থিতি, সেটি একবার পরখ করে দেখা যেতে পারে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অঘটনের খবর কারও অজানা নয়। ২০১২ সালে বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিশ্বজিৎ দাস নামের একজন দরজিকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধার ও বর্ধিত বেতন-ফি–বিরোধী আন্দোলনেও সংগঠনটি কেবল সতীর্থদের ওপর চড়াও হয়েছে, তা-ই নয়, শিক্ষকদেরও লাঞ্ছিত করেছে। বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনার সময় মীজানুর রহমান উপাচার্য পদে ছিলেন না। ছিলেন তাঁর পূর্বসূরি মেজবাহউদ্দিন আহমদ। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সংঘটিত অঘটন ও অনিয়মের দায় কীভাবে এড়াবেন? ২০১৬ সালে তিনি আইনকানুন ভেঙে ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা ছিল তাঁরা ছাত্রলীগ করেন। তখন নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে উপাচার্য পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র বা চাকরিপ্রার্থী বলতে কিছু নেই। এখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই চাকরি পাবেন। এটাই তাঁদের বিশেষ যোগ্যতা।’
এর আগে তাঁর পূর্বসূরি মেজবাহউদ্দিন আহমদ নিয়োগ দিয়েছিলেন ২২ জনকে। সেদিক থেকে মীজানুর রহমান সাহেব একটু পিছিয়ে আছেন। তিনি মেজবাহউদ্দিন আহমদের সমসংখ্যক ছাত্রলীগ কর্মীকে নিয়োগ দিতে না পারলেও সেটি পুষিয়ে দিয়েছেন এ কথা বলে, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র বা চাকরিপ্রার্থী বলতে কিছু নেই। এখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই চাকরি পাবেন। এটাই তাঁদের বিশেষ যোগ্যতা।’
আমরা জানি না, দেশে এখন এই বিশেষ যোগ্যতার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিবিধিতে সংযুক্ত করা হয়েছে কি না। করা না হলে উপাচার্য মহোদয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য তা বাধ্যতামূলক করার আরজি পেশ পারেন। তাতে সুবিধা হবে ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী নন, এমন কেউ চাকরির আবেদনই করবেন না। চাকরিদাতাদেরও অযথা বহুসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর দরখাস্ত যাচাই-বাছাই করতে হবে না। বিশেষ যোগ্যতা আছে, এমন প্রার্থীদের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া সহজ হবে। এখনো দেশে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা মনে করেন, ছাত্রলীগ না করেও হয়তো পড়াশোনার যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পাওয়া সম্ভব। তাঁরা যে বোকার স্বর্গে বাস করছেন, মীজানুর রহমান আবারও তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিলেন।
যুবলীগের বর্তমান চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর বয়স ৭১ বছর। মীজানুর রহমানের ৬১ বছর। সে ক্ষেত্রে তিনি যুবলীগ সভাপতির পদ চাইতেই পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো যুবলীগের সভাপতির পদে বয়সসীমা ৪৫ বছরে বেঁধে দেওয়া হবে বলে শোনা যাচ্ছে। যদি সেটি হয়ে থাকে, তাহলে মীজানুর রহমানের যুবলীগের সভাপতি বা চেয়ারম্যান হওয়ার বাসনা অপূর্ণই থেকে যাবে।
মীজানুর রহমান যুবলীগের সভাপতি হোন আর না-ই হোন, তাঁর দুটি রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবে না। প্রথমত, যুবলীগে থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন। তিনি বলেছেন, উপাচার্য হওয়ার পর যুবলীগের কোনো বৈঠকে তিনি যেতেন না। বৈঠকে না যাওয়ার অর্থ এই নয় যে তিনি সংগঠনটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। অর্থাৎ তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশে প্রথম যুব-উপাচার্য। আর দ্বিতীয় রেকর্ডটি হবে যদি তিনি যুবলীগ সভাপতি পদটি পেয়ে যান। তখন তিনিই হবেন প্রথম যুবলীগ সভাপতি, যিনি উপাচার্য পদ ছেড়ে যুবলীগ প্রধান হয়েছেন।
আগে প্রাক্তন ছাত্র বা যুবনেতারা পরিণত বয়সে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতেন। এখন পরিণত উপাচার্যরা যুবলীগের প্রধান হওয়ার জন্য কাতরতা দেখাচ্ছেন। সব সম্ভবের বাংলাদেশে সবই সম্ভব।
সূত্র: প্রথমআলো
No comments:
Post a Comment